
শহীদ ইয়াসির: স্বাধীনতার এক অমর নায়ক
শহীদ ইয়াসির স্মারকলিপি
যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তাদের মধ্যে একজন আমার ছোট ভাই শহীদ ইয়াসির।
নাম: মো ইয়াসির সরকার
পিতা: মো: ইউসুফ সরকার
পড়াশুনা: সরকারি আদমজীনগর এম ডব্লিউ কলেজ,ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের শিক্ষার্থী
ঠিকানা: ঢাকা,শনিরআখড়া,গ্যাস রোড
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ই আগস্ট
শহীদ হওয়ার স্থান: কুতুবখালী মেইন রোড
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যখন আবু সায়ীদ ভাই শহীদ হন,তাকে মেরে ফেলার প্রতিবাদে যখন বাংলাদেশের সর্বস্তরের স্কুল কলেজের বাচ্চারা রাস্তায় নামে তখন থেকেই ইয়াসিরের আন্দোলনের যাত্রা শুরু!
সারাদিন আন্দোলনে থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ৭ টা কি ৮টা বাজলো। আসার পর জিজ্ঞাসা করলাম আন্দোলনে গিয়েছিলি তাই না? বললো,হ্যা। ঝামেলা হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করাতে তখন বললো,
সবাই ভীতু,লাঠি হাতে কাউকে দেখলে সবাই একতাবদ্ধ হয়ে না থেকে সবাই এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে।আজকে কি হয়েছে জানিস, শনিরআখড়ায় অনেক স্টুডেন্ট ছিলো!কিছু মানুষকে লাঠি নিয়ে সামনে আগাতে দেখে আমি আর আমার সাথের একজন ওদের ইট ছুরছিলাম এমন সময় পিছন তাকিয়ে দেখি,আমাদের সাথে কেউ নেই,সবাই মোটামুটি অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে।ভয় না পেয়ে আমি আর আমার সাথের ভাইয়া কন্টিনিয়াসলি ইট ছুরাতে একজনের মুখে ইট পড়ে তারপর সে কিছুটা পিছন হলে ছাত্ররা সবাই পিছন থেকে এগিয়ে এসে আমরা সবাই মিলে তাদের তাড়িয়ে দেই।
ওর কথা শুনে দিলাম এক বকা!বললাম,তুই একা একা সামনে গিয়েছিস কেনো?বললো সবাই ভয় পেয়ে পিছনে চলে গেলে হবে নাকি?আম্মুও কিছুক্ষণ বকা দিলো,আম্মু শেষ কথা বললো যে আর আন্দোলনে যেতে হবেনা।
বড় ভাইয়া ওর এই কাহিনী শুনে এসে ওকে ইচ্ছা মতো বকা দিলো,সামনে এইভাবে গিয়েছে বলে।রাগ হয়ে বললো তুই আন্দোলনে গিয়েছিস কেনো?তুই যা পড়াশুনা করিস এই পড়াশুনা দিয়ে কি সরকারি চাকরি করবি?
বড় ভাইয়ার কথা শুনে ইয়াসির বললো,ভাইয়া আমি তো চাকরির জন্য যাইনি,দেখো না আমার ভাইদের মারতেসে তার জন্য আন্দোলনে গিয়েছি।
তারপর ভাইয়া আর কিছুই বলেনি।
আমরা কেউ আন্দোলনে যেতে মানা করলেই আমাদের বলতো আমরা সবাই রাজাকার।
আম্মু বাধা দিবে তাই আম্মুকে কখনো বলতো না যে ও আন্দোলনে যাচ্ছে।ফোন দিলেই বলতো আম্মু বাসার সামনে আছি।
একদিন আম্মু আর ইয়াসির বসে বসে কথা বলছিলো,যারা শহীদ হয়েছে তাদেরকে নিয়ে।ইয়াসির বলছিলো আম্মু দেখেছো কতো মানুষ শহীদ হচ্ছে! ওর কথা শুনে আম্মু বললো,
“যারা শহীদ হয় তারা তো চলেই যায়,কিন্তু তাদের মা বাবার কি অবস্থা হয়! মা বাবা সারাজীবন এই কষ্ট বুকে নিয়ে বেড়ায়!"
৩৫ জুলাই ৪ই আগস্ট
সেদিন থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।দুপুর বেলা আন্দোলন থেকে ইয়াসির বাসায় আসলো হাতে ব্যথা পেয়ে। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করাতে বললো, রাস্তায় এক এম্বুলেন্স যেতে দেখে কিছু ছেলেরা লাঠি নিয়ে এম্বুলেন্সে বারি দেয়া শুরু করে,আমার ভাই এম্বুলেন্সে বারি ঠেকাতে গিয়ে লাঠির বারি ওর হাতের আঙুলে লেগে আঙুল ফুলে যায়,ব্যথা সহ্য করতে না পেরে বাসায় চলে আসলো। বরফ এনে দিলাম ,বরফ দিচ্ছে আর আম্মু আম্মু বলছিলো।
আম্মু এসে বললো,বাবা দেখো একটা আঙুলে ব্যথা পেয়ে তুমি কতো কষ্ট পাচ্ছো,যারা আন্দোলনে গিয়ে পঙ্গু হচ্ছে তাদের কেমন কষ্ট হচ্ছে বলো?তুমি আর আন্দোলনে যেও না।
এর একটু পরেই শুনলাম কালকে লংমার্চ।
রাতের বেলা ইয়াসির বড় ভাইয়ার সাথে মজা করে বলতেসে ভাইয়া,কালকে আব্বু,আম্মু,তুমি আমি সহ বাসার সবাই লংমার্চে যাবো,কালকে লংমার্চে না গিয়ে বাসায় বসে থাকলে সেনাবাহিনী এসে ধরে নিয়ে যাবে!
৩৬ জুলাই ৫ই আগস্ট
সকাল প্রায় সাড়ে দশটা!আম্মুর ডাকে ইয়াসিরের ঘুম ভাঙলো।উঠেই ফোন নিয়ে বসে ফেইসবুকে দেখলো হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় আসছে।এমন সময় হুট করে নেট চলে গেলো।কিছুক্ষণ পর আম্মু এসে বললো বাহির থেকে আটা আর চিনি নিয়ে আসতে।আটা আর চিনি নিয়ে এসে বললো আম্মু আমাকে একটু লেবুর শরবত বানিয়ে দাও। শরবত বানিয়ে দিলে শরবতটাই খেলো,সকালে আর নাশতা করলো না।কিছুক্ষণ পর দেখলাম রেডি হচ্ছে বাহিরে বের হবে।বললাম ভাই আজকে যাওয়ার দরকার নাই,বললো না যাবো না ঐদিকে।
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আম্মু বললো বাবা ঐদিকে যাস না,বললো না আম্মু যাবো না।তখন সময় প্রায় ১২টা!
২টার সময় ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা হয়। আড়াইটার দিকে যখন খবর পেলাম দেশ স্বাধীন তখন খুশিই হয়েছিলাম কিন্তু কেনো যেনো মনে অস্থিরতা কাজ করছিলো। আম্মু ইয়াসিরকে ফোন দিচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না।একটু পর আমিও ফোন দেয়া শুরু করলাম কিন্তু নাহ ফোন রিসিভ করছে না।৩টার পর থেকে দেখি ফোনে আর কল যাচ্ছে না। এতো খুশির মধ্যেও মনে কেনো যেনো ভয় ঢুকে গেলো।আমি আম্মু একটু পর পরই কল দিচ্ছি কিন্তু ফোন বন্ধ।
সময় প্রায় সাড়ে ছয়টা,তখনো ফোন বন্ধ।আম্মুর ফোনে কোনো বন্ধুর নাম্বার না থাকায় বললাম আম্মু ইয়াসিরের ছবি দিয়ে ফেইসবুকে একটা পোস্ট দেই,ওর কোনো ফ্রেন্ড দেখলে ওর ব্যাপারে জানাতে পারবে। আম্মুর সম্মতি নিয়ে গ্রুপে পোস্ট করলাম যে ভাইকে ফোনে পাচ্ছিনা,কেউ দেখে থাকলে যোগাযোগ করতে বলবেন।
কমেন্টসে অনেকেই বলছিলো কোনো হসপিটালে দেখতে আবার অনেকেই কমেন্টসে কিছু লাশের ছবি দিয়ে জিজ্ঞাসা করছিলো এইটা আমার ভাই কিনা!
তাদের এইসব কমেন্টস দেখে খুব রাগ হচ্ছিলো যে আমি আমার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিনা বলে পোস্ট করলাম আর কিছু মানুষ আমাকে লাশের ছবি দিচ্ছে।বড় ভাইয়া আশে পাশে খোজ নিলেও কোথাও ইয়াসিরকে খুঁজে পাইনি।রাত প্রায় ১১টার দিক একজন আমাকে আমার ভাইয়ের ছবি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো এইটা আমার ভাই কিনা! মুহূর্তেই ইয়াসিরের ছবি দেখে মানতে চাচ্ছিলাম না যে এইটা আমার ভাই।বড় ভাইয়াকে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ভাইয়া এইটা আমাদের ইয়াসির না? ভাইয়া বললো এইটাই তো,কোথায় পেলি?
তাৎক্ষণিক ওই আপুর সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম আমার ভাই ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আছে।যাত্রাবাড়ী থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাওয়া হয়।তৎক্ষণাৎ আমরা ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। পৌঁছে দেখি আমার মেঝ ভাইয়া দাঁড়িয়ে কান্না করছে।আমার যেনো মাথা ঘুরাচ্ছে, ভাইকে দেখে মনে হলো আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি,চোখ খুললেই দুঃস্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো নাহ আমি কোনো স্বপ্নে ছিলাম না।ভাইয়ের গালে স্পর্শ করে দেখলাম মুখটা একদম ঠান্ডা হয়ে আছে,হাত ধরে দেখলাম হাতটা একদম শক্ত।বুঝতে পারলাম সে আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছে।তাও ইয়াসির ইয়াসির বলে ডাকলাম যদি আমার ভাই আমার ডাকে সাড়া দেয় কিন্তু নাহ আজকে আর আমার ডাকের সাড়া দিলো না।
ভাইয়ের ডান হাতে দেখলাম কালিমা তাইয়েবা লিখা একটা ব্যান্ডানা,যেটা আন্দোলনের সময়ে কিনেছিলো।মাথায় পড়তে মানা করেছিলাম বলে হাতে পড়েছে,এইটা হাতে থাকা অবস্থায়ই সে আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছে।বুকের একপাশে গুলি অন্যপাশে ব্যান্ডেজ করা।পিছনে কোনো গুলি আছে কিনা দেখার জন্য কাত করতেই দেখতে পেলাম পিঠ থেকে অনবরত রক্ত বের হচ্ছে।ছোটো ভাইকে এই অবস্থায় কখনো দেখতে হবে তা স্বপ্নেও কল্পনাও করিনি।সেদিন প্রথমবারের মতো আমার ছোটো ভাইকে নিয়ে এম্বুলেন্সে উঠি তাও এমন অবস্থায় যে আমার ভাই আর দুনিয়াতে নেই।সবাই একে অপরকে বুঝাচ্ছিলাম আমার ভাই তো শহীদ,সে জান্নাতী। কিন্তু চিরন্তন সত্য এইটাই যে,
“আমার ভাই শহীদ,সে আর কখনো আমাদের মাঝে ফিরে আসবেনা”।
ইয়াসিরকে নিয়ে আসার সময় ডেথ সার্টিফিকেটে চাইলে তারা দিতে নারাজ,বললো পোস্টমর্টেম করা লাগবে।ওকে আমরা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাই,এখানে পোস্টমর্টেম করার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে?পোস্টমর্টেম করতে থানা থেকে লিখিত নিতে হয় কিন্তু সে রাতে কোনো থানায় পুলিশ ছিলো না।তখন তারা বললো ২,৩দিন ওয়েট করে তারপর আমার ভাইকে নিতে।আমরা আমার ভাইকে পোস্টমর্টেম করে আর কষ্ট দিতে চাইনি সে রাতেই আমরা ওকে নিয়ে আসি।
গোসল করানোর সময়ও তার রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি।গোসলের পর জানতে পারলাম আমার ভাইকে ৩টা গুলি শেষ করে দিয়েছে।বুকের দু পাশে দুইটা,কোমরের মাঝ বরাবর পিছনের দিক থেকে একটা।বার বার একটা কথাই মনে হচ্ছিলো,একটা মানুষকে শেষ করতে একটা গুলিই কি যথেষ্ট না???
পরে আসলে জানতে পারলাম শনিরআখড়ায় সেদিন আমার ভাই পানিও বিতরণ করেছিলো,দুপুরের দিকে আমার ভাই গণভবনে যাওয়ার জন্য রওনা হয়।একদম সামনের সারিতে ছিলো সে।একজনের ভাষ্যমতে সামনে পুলিশ দেখে ইয়াসির তাদের ফায়ার করতে মানা করছিলো আর সেই পুলিশ ওর উপরেই গুলি করে।সম্ভবত কুতুবখালী থাকা অবস্থায় কোনো কারণ ছাড়াই যাত্রাবাড়ীর পুলিশগুলো তাদের উপর গুলি করে। সম্ভবত তখন সময় ছিলো ২.৫০। পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলিতে আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়।ওখানের অবস্থানরত গুলিবিদ্ধ হওয়া প্রত্যেকটা মানুষ স্পট ডেড।
আচ্ছা,আমার এই ১৮ বছরের ছোট্ট ভাইটার কি দোষ ছিলো?কেনো তাকে গুলি করা হলো?
তার জীবন শুরু হওয়ার আগেই কেনো তারা শেষ করে দিলো? ইয়াসির আমার পিঠাপিঠি ছোটভাই,পিঠাপিঠি ভাইবোন নাকি জোড়ার মতো,তারা আমার জোড়া ভেঙে দিলো কেনো?আমার মা বাবার সন্তানকে তারা কেড়ে নিলো কেনো,কি দোষ ছিলো তার?তারা কি জানে না মায়ের বুক খালি করলে মায়ের কি পরিমাণ কষ্ট হয়?আমার ছোট ভাইটাকে আমাদের থেকে একবারের জন্য দূরে সরিয়ে দিলো।যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না।ভাই নেই ভাবলেই দুনিয়াটা কেমন যেনো মনে হয়।ভাইয়ের শখের সাইকেল,শখের স্বাধীনতা,শখের দেশ সবকিছুই আছে।শুধু আমার ভাই নেই!এই জীবনে ভাইকে আর কখনো দেখতে পাবো না এমনকি ভাইয়ের সাথে বসে দুইটা কথাও বলতে পারবো না!
নিশ্চই আল্লাহ উত্তম বিচারক। আমরা আমার ভাই হত্যার বিচার চাই।আমরা চাই এর সুষ্ঠ তদন্ত হোক।এই নির্মমতার বিচার এই জমিনে হবে কিনা জানিনা কিন্তু নিশ্চই আল্লাহ এর ন্যায় বিচার করবেন।
আন্দোলনে শহীদ হওয়া বাকি সবার মতোই আমার ভাই একজন শহীদ বীর। আল্লাহ যেনো ভাইয়ের শাহাদাতকে কবুল করে তাকে শহীদের মর্যাদায় সমুন্নত করেন এবং জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন।আমরা চাই আমার ভাই যেনো তার প্রাপ্য সম্মান পায়।
সবাই ইয়াসিরের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করবেন।আমিন!
ইয়াসিরের সাথে শহীদদের নিয়ে মায়ের কথা বলার সময়ের ওই কথাটা এখন বাবা মাকে দেখলে খুব অনুভব করি, "তারা তো শহীদ হয়ে আল্লাহর কাছে চলেই যায় কিন্তু মা বাবার কি অবস্থা হয়,তারা এক বুক কষ্ট নিয়ে কীভাবে থাকে?”