এবারের বন্ধু দিবসে ওকে ছাড়া কাউকে হয়তো আমরা কেউ এতটা মিস করব না। আমার বন্ধু শহীদ ইরফান ভূঁইয়া। ওকে আমি ইরফু ডাকতাম বেশি। জানা ছিল না আমি বাদে কেউ এই নাম ডাকত তবে যতদূর শুনলাম এই নামে ওকে অন্য কেউ ডাকলে ও রেগে যেত, তবে এই কারণে ওকে আমার উপর কোনোদিন রাগতে দেখিনি। শুরুটা এমন যে ইউআইইউতে অনেকটা জেদ করেই ভর্তি হই ভালো কিছুর আশায় ২রা জানুয়ারি, ২০২৩ । সেটাও বাসায় অনেক রেষারেষির পর। ফ্রেশার ভাইবস তাই যেমন খুশি তেমন ফ্রেশার অ্যাড করতে থাকি নতুন ফেসবুক আইডি খুলে। ইরফান একদম আমার প্রথম দিকের ফেসবুক ফ্রেন্ড ভার্সিটিতে। ও আর আমি দুইজনই সিএসইতে অধ্যয়নরত ছিলাম, ওর সাথে আমার প্রথম কথা হয় ঐ বছরই ২৫শে জানুয়ারি ওর ফেসবুক স্টোরিতে দেখা আইয়ুব বাচ্চুর “মেয়ে” গানের রিল চাইতে গিয়ে। ছেলেটা বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের চরম ফ্যান বিশেষ করে “ওয়ারফেজ” ব্যান্ডের। এর বাইরেও অর্থহীন, শিরোনামহীন, কাকতাল, ব্লাকসহ আরও কিছু আন্ডাররেটেড ব্যান্ডকে খুব প্রমোট করত ও। অনেক রুচিশীল মিউজিক টেস্ট দেখে আমি বেশ প্রশংসা করতাম সবসময়।

সেই ক্লাস থ্রি থেকেই নাকি নকিয়া ফোনে ওর রেডিও শুনে শুনে এই বাংলা মিউজিকের প্রতি আগ্রহ ও বলত। ২৮শে জানুয়ারি আমাদের প্রথম ক্লাস হয় আমাদের দেখা হয় নি তবে কে কতদূর পৌঁছালাম, কয়টাই কার ক্লাস খবর নিচ্ছিলাম ম্যাসেজে।

১লা ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মত ভার্সিটি শাটল বাস থেকে নতুনবাজারে নামার পর আমি ওকে ফেসবুকে আপলোড করা ছবির মত ফিটফাট দেখি একটা সানগ্লাস চোখে, জিজ্ঞেস করি চিনতে পারছে কিনা ও সম্মতি জানায়। ফেব্রুয়ারি মাসেই ১৩তারিখ আবার কথা হয় নিজেদের আইডি-রোল এসব নিয়ে, হিসেব করে দেখলাম একসাথে কোনো সেকশনই মিলবে না কারণ আমাদের আইডির মধ্যে ১২৩জন মানুষের দূরত্ব বিদ্যমান আর ফ্রেশারদের সেকশন ভার্সিটি থেকেই ঠিক করে দেয় ।

২৫শে ফেব্রুয়ারি তখন ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ নির্মাণাধীন থাকায় তাদের ক্লাসও আমাদের সাথে হত ভার্সিটির অষ্টম এবং নবম ফ্লোরে, তো এক স্কুল ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়ে গেলে কথা বলি, মেডিকেলের স্টুডেন্টের সাথে কথা বলা দেখে ইরফান আমায় খোঁচা মেরে বলে যায় কিরে ভাই ডিপার্টমেন্ট চেঞ্জ করবা নাকি মেডিকেলে যাবা? সেন্স অফ হিউমার দারুণ ছিল ছেলেটার।

(ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা)

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ বাসায় এসে আমি স্বপ্নে ওকে দেখি তো ওকে বললে ও বলছিল যশোর-খুলনা ওর খুব ভালো লাগে ও ঘুরতে আসবে। ইতিমধ্যে ও আগেই একবার মজা করে ওর বাসায় আমাকে দাওয়াত করেছিল। আমাকে হঠাৎ একদিন জিজ্ঞেস করে ঘুম না আসলে কি করব ভাই? বলছিলাম, “আয়াতুল কুরসি পড়, ঘুমের দোয়া পড়, ওযু কর, ৫০০ থেকে ১ পর্যন্ত উল্টা কাউন্ট কর, তারপরও ঘুম না আসলে ঘুমের ওষুধ খাও তবে অভ্যাস করো না।” তখন ও বলল,” আমি চাইলে নিজের স্লিপ সাইকেল নিজে নষ্ট করে নিজেই ঠিক করতে পারি।”

ওর সাথে শুরু থেকেই পরিচয় থাকলেও অফলাইনে আমরা শুরু থেকে এত ক্লোজ ছিলাম না, এ বছরের শুরুতে ও আমাকে বলে গ্রীষ্মের ছুটিতে ওকে আমার গ্রামে ঘুরতে নিয়ে গেলে তো পারি..

আমি ওকে বলি আচ্ছা আসলে এবারই আসো আমরা পরিবার নিয়ে ঢাকা শিফট করব, তখনও আমাদের তুমি তুমি সম্পর্ক। এরপর আমি ওকে সারাদিন আমার গ্রামীণ ফটোগ্রাফি দেখাতাম ও বলত এবার কিন্তু আমাকে নিয়ে যেতেই হবে। এরপর আমাদের ভার্সিটিতে ২০শে জানুয়ারি, ২০২৪ এ দেখা হয়। ২৩ তারিখে ক্লাস শুরু তাই সেকশন সিলেক্ট করা বা বদলাতেই আগে আগে ঢাকাতে আসা। এরপর ও রবি,বুধ ক্লাস নিতে না চাইলেও আমার সাথে ডিএলডি সেকশন নিবে বলে একটা ক্লাস নিয়েই ফেলে, এরপর শুরু আমাদের পাক্কা বন্ধুত্ব। ছেলেদের কখনও বেস্টফ্রেন্ডকে বেস্টফ্রেন্ড বলতে হয় না ওর সাথে আমি যে এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছি ওর মৃত্যুর আগে কোনোদিন উপলব্ধি করতে পারিনি। ক্লাসে নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয় বেনজির স্যার আমাদের দুইজনকেই ভালো করে চিনতেন। পরিচিত মুখ হয়ে যায় প্রথম দুই সপ্তাহের মাঝেই। এমনও দিন গেছে ইরফান ভিডিও কল করে আমাকে খাতা বের করে আমাকে পড়া দেখিয়েছে, এমনও দিন গেছে আমি লাইট অফ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওর ম্যাসেজ দেখে নোটপ্যাডে এঁকেএঁকে ওকে স্টেট ডায়াগ্রাম দেখিয়েছি, খুবই নিঃস্বার্থ ছিল ছেলেটা তাই আমারও ওর প্রতি ১২০% এফোর্ট দিতে কখনও অনিচ্ছা হত না। আমার ক্যালকুলেটর নষ্ট হলে সে নিজের অথবা তার এসএসসি ক্যান্ডিডেড ছোট বোনদের ক্যালকুলেটর আমার জন্য রেখে যেত, পরে ও ভার্সিটিতে না আসলে ওর আব্বুর কাছে পাঠিয়ে দিতে বলত। ওর আব্বু আমাদের ভার্সিটিরই স্টাফ। ওর বাসা দূরে হওয়ায় ক্যালকুলাস পরীক্ষার আগের রাতে ও আমার মেসে থাকতে চায়, আমিও ও নিশ্চিত থাকবে জেনে একটা এক্সট্রা মিল চালিয়ে দেই, পরবর্তীতে না আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে ও বলেছিল ওর নোট খাতা আনতেই ভুলে গেছিল তাই ফেরত চলে গেছে, ওই খাতা ছাড়া নাকি ওর ক্যালকুলাস পড়া অচল, এভাবেই আমাদের নাইট আউট, ট্যুর সব বাকি রয়ে গেছে, অছিম পরিবহনে উঠত বেশি ও বাসায় যাওয়ার জন্য। আমার সাথে ইস্পাহানি ইসলামিয়া আই হাসপাতাল এ যাওয়ার কথা ছিল, ওর এক চোখের পাওয়ার একটাই ১.২৫ আরেকটাই –০.৫ ছিল খুব সম্ভবত। আমাদের সময় মিলত না বাসা দূরে হওয়াতে। কিন্তু রাত জেগে অকারণে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলছি আমরা কখনও জীবন নিয়ে, কখনও ওর প্রিয় ব্যান্ড ওয়ারফেজের গান অথবা মিজান বাদে মেইন লাইনআপের সবাই থাকবে এবারের কনসার্টে এসব নিয়েই কথা হত বেশি।

(পছন্দ ও অপছন্দ)

ভার্সিটিতে ওর সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষিকা ছিল আনিকা তাসনিম রোদেলা ম্যাম আর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন ত্বকী ইয়াসির স্যার, আমাকেও একবার ইরফান সাথে নিয়ে স্যারের রুমে পড়া দেখতে গিয়েছে।

শাহরুখ খান কে অনেক বেশি কপি করত, বাংলাদেশে অপি করিম ওর খুব প্রিয় ছিল, লেখালেখি অনেক বেশি পছন্দ করলেও দেখাইতে লজ্জা পেত আমাকে। একবার দেখিয়েই আবার ডিলিট করে দিত লজ্জায়। তবুও ফেসবুকে অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি রেখে গেছে সে।

প্রিয় ফুটবল টিম ছিল রিয়াল মাদ্রিদ আর ব্রাজিল। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো প্রিয় ফুটবলার আর ট্রাভিস হেড প্রিয় একজন ব্যাটসম্যান।

আর মেটাল ব্যান্ড ‘ওয়ারফেজ’ ছিল ওর লাইফ।

প্রোগ্রামিং-এর জন্য ভিএস কোড ব্যবহার করা শিখেছিল ছয় মাস অনেক ইফর্ট দিয়ে তারপর আমায় বলেছিল আমাদের ভার্সিটির ছাত্ররা কষ্ট করতে চাইনা, ভিএস এ কোড করে কে মজা এরা বুঝবে না।

সব বন্ধুকে সব কিছু শেয়ার করত না ও, একজনের কথা আরেকজনের কাছে যাওয়াটাও ওর একদমই পছন্দ ছিল না। সবারই চোখের মধ্যমণি ছিল ও। আজ অবধি কেউ ওকে নিয়ে বাজে কথা বলে না। বন্ধুত্বের সেরা উদাহরণ ছিল বেচারা।

(বন্ধুত্ব)

ভার্সিটির শুরু থেকে যে বন্ধুগুলোর সাথে ইরফানের উঠাবসা তারা হল ইমরান, পলি, লাবণ্য। ওরাই প্রথম ট্রামিস্টারে একসাথে আড্ডা দিত ঘুরত, ইরফানকে লুকিয়ে চলতাম আমি খুব। নয়তো খুব পঁচানির উপর রাখত ছোট ছোট বিষয় নিয়ে। ওর প্রিয় একটা ডায়ালগ ছিল, “তোমরাই খেলো।” ও নিজেকে নারায়ণগঞ্জের ওবাইদুল কাদের দাবি করত কারণ ও খুব ভালো মিমিক্রিও করতে পারত লোকটার। এছাড়া আমাদের বেনজির স্যারেরও মিমিক্রি পারত সুন্দর। এর বাইরে এনায়েত, প্রত্যয়, নাইম, ইমন, মইনুলরা ওর বেশ কাছের। এছাড়া বেস্টফ্রেন্ড ছিল পিয়াল, ওরা একই এলাকা থেকে ভার্সিটিতে আসত। পিয়াল থেকে জানা ইরফানের একটা ভালো পিসি বিল্ড করার অনেক ইচ্ছা ছিল, ১০০% স্কলারশিপ পেলে ওই টাকা দিয়ে এটা করবে ঠিক করেছিল, আগেরবার মিস হয়ে যায়, তাই এইবার অনেক বেশি চেষ্টা করছিল। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থাকায় ও বাইরে তেমন খেতে চাইত না তবে রং চায়ের একান্ত ভক্ত ছিল আমাদের ইরফান একথা কারও অজানা নয়। আর মাঝে মাঝে একসাথে ভার্সিটির পিছনে সিংগারা খেতে যেতাম আমরা। ওর এলাকার বন্ধু সামাদ পোদ্দার খুবই কাছের একজন, এইতো এই ১৫ই জুলাই সে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানার আগেও ইরফান তার সাথে একটা শেষ ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়, তার থেকে জানা ইরফানের গাড়ির খুব শখ ছিল, মার্কেটপ্লেসে সারাদিন টয়োটা গাড়ি দেখে বেড়াত ইরফান। লাবণ্য আর পলি থেকে জানা ইরফান প্রথম দিকে সিএসইতে আগ্রহী ছিল না, তার পছন্দ ছিল ইইই ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু বাবার চাপে সিএসইতে ভর্তি হয়েছিল, কারণ তার বাবা মনে করতেন চাকরি পাওয়ার জন্য সিএসইই ভালো। বলা বাহুল্য ইরফানের বাবা হচ্ছেন ইউআইইউ ইইই ডিপার্টমেন্টের ল্যাব ইনচার্জ। প্রোগ্রামিং কঠিন লাগলেও ওর ম্যাথ খুব ভালো লাগত, তবে পরবর্তীতে ওর মেশিন লার্নিংএর দিকে আগ্রহ জন্মায়।

ইরফান আংকেলকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল সে সিএসই পড়তে আগ্রহী না, কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পর বাবার সাথে তার কম কথাবার্তা হত। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার পর ইরফানের বাবা-মা বলেছিলেন, তারা ওকে ঢাকার বাইরে পাঠাবেন না যদি সে সাস্টে ভর্তি না হতে পারে। এ কারণে সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি।

তবে ভাগ্যের জোরে সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেক্ট হয়েছিল, কিন্তু পছন্দের সাবজেক্ট না পাওয়ার কারণে তার ভর্তির আগ্রহ ছিল না। ঢাবিতে তার মেধাক্রম ছিল ৫৯৯২তম এবং একদিন তার মা জানতে পারেন যে ইরফানের নানার মুক্তিযোদ্ধা কোটার সার্টিফিকেট আছে, যা ইরফান বা ওর আম্মু আগে জানত না, ঐ দিনই প্রথম জানে। ঢাবিতে ভর্তি হতে না পারার কারণে সে খুব আফসোস করতো। ঢাবি ছিল তার ৪-৫ বছরের স্বপ্ন। সে মেডিকেলে চেষ্টা করেনি ঢাবিতে ভর্তি হবে বলেই।

যেদিন ইরফান ইউআইইউ থেকে আইডি কার্ড পেয়েছিল, ও পলিকে বলেছিল যে অনেক ম্যাচিউরড ফিল করছে। মেট্রোরেল উদ্বোধনের দিন, ইরফান তার নিজের কণ্ঠে গেয়েছিল, “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, মেট্রোরেল মেট্রোরেল মেট্রোরেল।”

১৫ই জুলাই, ২০২৪ পলি, ইরফান আর আমার একসাথে শেষ কথা হয়েছিল একটি অ্যাসাইনমেন্টের কভার পেজ নিয়ে, যেটা পলি আমাদের টিমের জন্য করেছিল। আমি আন্দোলনের তীব্র ব্যস্ততার মধ্যে গ্রুপে আর রিপ্লাই দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি সেদিন।

(অতিরিক্ত সংযোজন)

DLD ক্লাস একসাথে করার সময় ফখরুল, আনিকা, আমি, ইরফু, রেজা বক্স আর সাজ্জাদের একসাথে গ্রুপস্টাডি করতে গিয়ে অনেক ভালো বন্ডিং হয়, আমি গ্রুপটার নাম দেই FAIRS কেউ বুঝে নাই কেন আসলে সবার নামের প্রথম অক্ষর ব্যবহার করে এটা করা FAIRS এর I টা আজ আমাদের মাঝে নাই তাই হয়ত সবকিছু দূর(FAR) লাগছে। রাতবিরাতে এরা গ্রুপে একজন আরেকজনের গল্প শুনত আর জ্বালাতন করত খুব। আনিকা বেশি হাসলে আবার নিজে থেকেই বলত আসিফ ভাই, ইরফান ভাই পড়তে যান। এছাড়া এবার SOC সেকশনে ইরফু, আমি, পলি, বুশরা, তানভীর আর কামিশকা একসাথে টিম করেছিলাম। নাম ছিল WARKIT. শেষ ও আমাকে Aevesham মুভিটা দেখতে সাজেস্ট করেছিল।

ইরফান SOC ক্লাস কিছু দেখত না শুধু ফোনে খেলার স্কোর অথবা DSA-1 দেখত খাতায়, জিজ্ঞাসা করলে বলত DSA পারিনা রে mid নিয়ে চিন্তায় আছি। এখন ওর আর পরীক্ষায় দিতে হবে না।

(আলোচিত এবং শেষ পোস্ট)

১৩ই মে ও ফেসবুকে লিখেছিল,

“এই যে বাসায় আসবো না বলে বাসায় চলে আসলে আম্মা কতো খুশি হয়, এই খুশি কেড়ে নিয়ে আমি কেমনে তোমাদের মতো বিদেশ পাড়ি দেই বলো? বন্ধুদের, বড় ভাইদের “দেশে কিছু করতে পারবি না” এই কথাকে আমার একটুও ভয় লাগে না, বৃদ্ধ বয়সে আব্বা আম্মার কাছে থাকতে চাই। কপালে যা আছে তাই হবে, বাপ মা ছাড়া থেকে হাজার কোটি টাকা কামাইলেও যে শান্তি পাবো না আমি।

আমার আব্বা আম্মা আবেগ দেখাইতে পারে না, তাই শাসনে আবেগ রাখে। আমি একসময় এতো শাসন নিতে পারতাম না। কিন্তু এই তীব্র শাসনে যে তীব্র আবেগ লুকায়িত থাকে, বুঝার পর থেকে তাদের শাসনে যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু সমাজের চাপে অনেকসময় শাসনে পড়ে যাই। সমস্যা নাই, ওরা এই তীব্র শাসনে আমায় ভয়ও পায়, আমি হয়তো উন্নত জীবনের খোঁজে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবো।

আমারও কখনো তাদের তীব্র শাসনের বিপরীতে মুখে বলতে ইচ্ছা করে না, “তোমাদের দাফন পর্যন্ত পাশে থাকতে চাই”।

এইটা ওর খুব আলোচিত একটা ফেসবুক পোস্ট।

এছাড়া ১৬ই জুলাই যখন আমরা নতুনবাজারে আন্দোলনে ব্যস্ত ঠিক তখন ইরফান ফেসবুকে পোস্ট করে,

“বীর বাঙ্গালী কোথায় ছিল, যখন ভারত বাংলাদেশের বুক চিরে রেল ট্রানজিট নিলো?”

সেদিন ওর সব ক্লোজফ্রেন্ডরা ওর বিরুদ্ধে যায় অনেকে ওকে ভণ্ড বলে। আমি নিজেও কমেন্ট করি, “এই জন্যে আসিসনি? ও বলে,” হ্যাঁ ” ভেবেছিলাম রাতে ওকে বলবো নিজে না আসলেই আমাদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব না ঢোকাতে। কিন্তু রাতারাতি ছেলের বিবেক জাগ্রত হয় পরিবর্তিত মন নিয়ে ছেলেটা আবার ফেইসবুকেই পোস্ট করে,

” উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় কাটছে দিন;

নিজেকে নিজের থেকে দূরে রাখতে চেয়েও মনে হয় পারলাম না। কালকে দেখা হবে, এর শেষ হওয়া পর্যন্ত আছি!” সেই বহুল আলোচিত পোস্ট। এই পোস্টের ২৪ঘন্টা হওয়ার আগে সে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয় অনন্তপানে।

(মৃত্যু)

১৮তারিখ অর্থাৎ ওর মৃত্যুর দিন সকালে ওর পেট খারাপ করে কিন্তু ঘরে মন টিকে না, সে ঠিকই বের হয়ে যায়। তার আগের দিন রাতে ও স্টাফ কোয়ার্টারের ফ্রেন্ডের নিয়ে একটা গ্রুপ করে বলেছিল এসে ফরজ গোসল নিবে, নিয়েছিল ঠিকই সে কিন্তু জীবিত থাকা অবস্থায় নয়। সকালে আমার সকল পোস্টেও কমেন্ট করছিল ব্রাকের দিকে আসবে কিনা, আমার জবাব না পেয়ে ইনবক্সে আসে, আমি জিজ্ঞেস করি কোথায় ও, বলছিল সানাড়পাড় থেকে চিটাগাং রোডের দিকে যাচ্ছে আমি বলেছিলাম মানুষ থাকলে আসতে পারিস, একা অবশ্যই আসবি না। ও বলছিল, “ঠিক আছে, বনশ্রী আইডিয়ালের রাস্তা ধরে ইস্ট ওয়েস্ট ভার্সিটির ছাত্রদের সাথে আসবো” কিন্তু লোকজন না পাওয়াতে সে যাত্রাবাড়ি শনির আখড়ার দিকে যায়। ওর যেসব পরিচিত বন্ধুরা ছিল ওকে সাথে নিয়ে চলে যেতে চাইলেও ও থেকে যায়, পরবর্তীতে ওদের ফোন করে যখন জানতে পারে ওরা বাসায় চলে গেছে ও রাগ করে, তবে ইরফান ওইদিন ফিরে আসার জন্যে রাস্তায় নামে নি। হয়তো সাহসিকতা আর বোকামির মধ্যে তফাৎটা যে ঠিক কোথায় তার হিতাহিত জ্ঞানটা ও হারিয়ে ফেলেছিল।

দুপুরে ১২:৩৪ এ আমার সাথে ওর শেষ কথা হয়, বিকাল ৫:৩১এ শান্ত কল করে বলে পিয়াল ওকে জানিয়েছে ইরফানের গুলি লাগছে। ততক্ষণে আমি জানি ব্রাকের সামনে আমার কাছের দুই বন্ধু হামিম আর সিয়ামের রাবার বুলেট লেগেছে তো আমার কাছে ওইদিনের হিসেবে স্বাভাবিক ঘটনা মনে হওয়ার কথা। কিন্তু ইরফানের ব্যাপারটা কেন জানি হজম করতে পারছিলাম না। তাড়াহুড়ো করে আংকেলের নাম্বার চাইলাম সবার কাছে, বাসার ঠিকানাটা যে জানিনা ঠিকমত। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করে বলে ভাইয়া আমাদের ভার্সিটির একজন দেখেন তো চিনেন কিনা? ফোন হাত থেকে পড়ে যায়, আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি, বিষয়টা আমি তিন-চারদিন স্বাভাবিক ভাবে নিতেই পারিনি। কারণ মা বোন নিয়ে দুই দিন আগেও আমি ঢাকাতেই ছিলাম।

গতবছর জুলাইতে আব্বু ক্যান্সারে মারা গেলেও আমি বলতে গেলে একদম কাঁদি নাই প্রায়, তার বয়স হয়েছে, রোগ ছিল অনেক দিন আল্লাহ মুক্তি দিয়েছিলেন হয়তো। যেটুকু কেঁদেছি রক্তের সম্পর্ক আছে বলে নয় তার মত ভালো মানুষের সন্তান হতে পেরেছি বলে কেঁদেছিলাম..

কিন্তু আমার নির্দোষ ভাইয়ের অনাকাঙ্খিত মৃত্যু আমার পক্ষে মেনে নেওয়া যেন কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না, ভাবছিলাম আমরা কি সন্ত্রাসী? আমাদের আন্দোলন যদি অযৌক্তিকও হয় কিভাবে আমাদের উপর গুলিবর্ষণ করে ওরা? তাদের উপর আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো আঘাত করেছি? যেটুকু করেছি আত্মরক্ষার্থে নিজেকে বাঁচাতে। আন্দোলনে বারবার আমার বন্ধুরা হাতে লাঠি, পাথর গুঁজে দিলেও আমি তা বারবার ফেলে দিয়েছি, মাস্ক পড়তে দিলেও পড়িনি। বলেছিলাম, “আমি কি কোনো দূর্বৃত্ত, আমাদের আন্দোলন কি কোনো অর্থে অযৌক্তিক? তাহলে আমাদের রাজাকারের বাচ্চা কেন বলল? আর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা এত বেশি মেধাবী হলে তাদের কোটার দরকার হয়?” যারা আন্দোলনে আগে আসে নি তারাও আমাদের গায়ে হাত তোলার পর আমাদের সাথে নেমে গেল তাহলে যাইহোক গুলি কেন চালাবে বন্ধুদের গায়ে? এইসব লিখতে লিখতে দেখি আমার ইন্টারনেট আর কাজ করে না…

ইন্টারনেট একদম বন্ধ রাতে ওর স্কুল ফ্রেন্ড ওমর ফোন দিয়ে জানায় যাত্রাবাড়ির দিকে অবস্থা খুব খারাপ, জানাজা পড়ানো গেল না, লাশ নিয়ে ওর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী যাওয়া হচ্ছে জানাজা কবর ওখানেই। তখন সময় ১৮তারিখ রাত সাড়ে দশটা।

(মৃত্যু পরবর্তী তথ্য)

ইরফানের এক কাছের আত্মীয় বড় ভাইয়ের তথ্য অনুযায়ী,

পুলিশের শর্টগানে খুব কাছ থেকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সে সেইখানেই মারা যায়, তারপরও মৃত্যু নিশ্চিত করতে ইরফানের দেহটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে অনেক মারা হয়। যার ফলে তার হাতের হাড়, কনুই ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। তার বুকের পাঁজর ভেঙে যায়, তারপর ব্রিজের উপর থেকে তাকে ফেলে দেয় যার ফলে তার মাথা ফেটে যায়। এক কথায় বলতে গেলে সে স্পট ডেড ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে এন্ড হাসপাতালে আনলেও কোনো লাভ হয় না। গুলিটা লেগেছিল পিঠের ডান দিকে, পিঠ দিয়ে বড় ছিদ্র করে ঢুকলেও সামনে দিয়ে আর সেটা বের হয় নি। ইরফানের বাসায় এখনও সব ওইভাবেই পড়ে আছে, আন্টি এখনও মেনে নিতে পারেন না, আংকেল কম কথার মানুষ শোকে আরও বেশি কাতর, ইরফানের ঘরের মশারিও এখনও অমন পড়ে আছে, খোলা আর হয় নি।

লেখাঃ আসিফ রহমান
শহীদ ইরফান ভুঁইয়ার বন্ধু

Shares: