গত কয়েকদিন কার কিভাবে গেছে জানিনা..

কিন্তু যারা মাঠে নামেন নাই..যুদ্ধক্ষেত্র দেখেন নাই..তারা কল্পনাও করতে পারবেন না দেশে কি চলেছে..

১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার দুপুর ১ টায় আমার বন্ধু  জাহিদুজ্জামান তানভীন শহীদ হয়..তার খবর পেয়ে সাথে সাথেই আমরা কুয়েত মৈত্রি হাসপাতালে রওনা দেই ২ টার দিকে..আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলোনা..নিজের চোখে না দেখে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলামো নাহ..খালি মনে হচ্ছিলো হয়ত অন্য কেউ হবে..তানভীনের মত দেখতে কেউ হয়ত..

রাস্তায় বাইক আর সিএনজি ছাড়া কিছু ছিলোনা..অনেক অপেক্ষার পর একটা সিএনজি পাই যে আমাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাইতে চায়..

উত্তরা জসিমউদ্দীন আসতেই আমাদেরকে ছাত্র রা থামায় দিয়ে বলে ভাই সামনে যায়েন না..পুলিশ যেদিকে যেভাবে পারছে গুলি করছে..

আমরা সিএনজি ঘুরাই..ডিভাইডারের মাঝখান দিয়ে পার হয়ে সেক্টর ৪ এ ঢুকি..গলির মুখেই দেখতে পাই ৪০-৫০ জন মত ছাত্রলীগ জমায়েত হয়ে আছে..বসে ছিলো বেশিরভাগ দেখে আমাদেরকে কিছু বলেনাই..

সিএনজি ঘুরায় ঘুরায় কোনমতে কুয়েত মৈত্রি এর কাছাকাছি যাইতে পারি..আজমপুর রেলগেটে নামি..

দেশের এই হাজারো সুশীলরা চুপ থাকলেও সেইদিন সিএনজিআলা মামা আমাদেরকে বলে যে আমি সমর্থন করি মামা এই আন্দোলন..আপনাদের বন্ধু শহীদ হয়েছে আজকে..আপনাদের থেকে কিভাবে টাকা নেই আমি..অনেক বলে কয়েও তাকে টাকা দিতে পারিনাই আমি..

হাটা দেই হাসপাতালের দিকে..পথে শয়ে শয়ে ছাত্রছাত্রি দেখি..বিভিন্ন ভার্সিটির..কলেজের..এমনকি স্কুলেরও..সবাই আশঙ্কিত যে না জানি কি হয়..

কারো গায়ে ইউনিফর্ম..গলায় প্রত্যেকের আইডি কার্ড..কারো সাথে হেলমেট..চোখের নিচে টিয়ার শেল থেকে বাঁচতে পেস্ট..প্রতিরক্ষার জন্য হাতে কারো কারো লাঠি..রেকর্ড করার জন্য কারো হাতে মোবাইল..

হাসপাতালে পৌছাই..বাইরে শয়ে শয়ে শিক্ষার্থি হাসপাতাল ঘিরে রাখেছে..ভেতরে যারা আছে তাদেরকে রক্ষা করার পণ নিয়ে..

বাইরে থাকতেই আওয়াজ শুনি যে ভাই নর্দার্ন ভার্সিটির একটা লাশ আছে..কেউ পারলে আসে আইডেন্টিফাই করেন যে লাশটা কার..

হাসপাতালের সামনে থেকেই শুনা যাচ্ছে বিএনএসে গোলাগুলির শব্দ..বিএনএসের দিকে ধোঁয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছেনা..চারদিকে ইট..ভাঙা কাঁচ..

গেটে যাই..ছাত্ররা আটকায়..প্রথম কথা আপনি কোন ভার্সিটির? বললাম যে ভাই আইইউটির আমি..সাথে সাথে বলে ভাই ভেতরে আসেন..আইইউটির একটা লাশ আছে..

বুকটা ধক করে উঠে..তখন মনে হয় আসলেই কি তানভীন? আনসার এর এক লোক আমাদেরকে লাশ রাখার ঘরে নিয়ে যায়..পাশাপাশি ৪ টা লাশ..দ্বিতীয়টা তানভীনের..

আশপাশে অসংখ্য ছাত্র আহত..প্রায় সবার গায়ে স্পলিন্টার..হাতে পায়ে মাথায় অনেকের ব্যান্ডেজ..ডাক্তার দের দৌড়াদৌড়ি..আহতদের আর্তনাদ..

ধরে রাখা কষ্টকর হচ্ছিলো নিজেকে..কিন্তু আশপাশে থাকা ছাত্ররা বলে ভাই ইনার মা এসেছেন..ভেতরে আছেন..

ভেতরে যাই..তানভীনের মা একটা বেডে বসে তানভীনের খালাকে ধরে কাঁদছেন..আমাকে দেখেই বলেন যে আকাশ আমার ছেলেটা তো নাই..কি নিয়ে বাঁচবো আমি বলো..কিভাবে থাকবো আমি একা..

কিছু বলার ভাষা ছিলোনা তখন..কাঁদতেও পারিনাই আন্টির সামনে..আন্টি আমার হাত ধরে কাঁদছিলেন শুধু..

হঠাৎ করেই আওয়াজ আসে যে পুলিশ আর লীগ ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করছে..আমরা কয়েকজন দোতলায় উঠে যাই..আইসিইউর সামনে দাঁড়াই..ভেতরে সব বেড ভর্তি..অনেকের গুলি লেগেছে..অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক..

ছাত্ররা সব দৌড়ে যায় যে পুলিশ কে ঢুকতে দিবোনা..লাশ নিয়ে যাইতে দিবোনা..

কিছুক্ষন পর আবার শান্ত হয়ে আসে ভেতরের সব..নিচে নামি..কিছুক্ষন অপেক্ষার পর তানভীনের রিলিজের কাগজ আসে..আমাদেরকে বলে লাশ নিয়ে যাইতে..

আমরা যারা ওর বন্ধুরা আছি..আগায় যাই লাশ নিতে..স্ট্রেচার আনি..ওকে তুলি স্ট্রেচারে..আমি মাথার নিচে হাত দেই তুলার সময়..রক্তে ভেজা..

মুখে আর বুকে অসংখ্য স্পলিন্টার লাগা..বুকের উপরে কাঁধের পাশে বুলেটের ক্ষত..মাথার পিছনে থেঁতলে যাওয়া..

লাশ নিয়ে আমরা সামনে আগাইতে নিলাম তখন একযোগে আশপাশের সব ছাত্র রা চিৎকার করতে শুরু করলো যে শহীদ ভাইয়ের লাশ..স্টিলে স্টিলে বাড়ি দিয়ে সবাইকে এলার্ট করলো যেনো সামনে থেকে সরে যায়..আল্লাহু আকবার বলে ধ্বনিত হইলো চারপাশ..

আশপাশের কাউকে আমি চিনিনা..কেউ আমাকে চিনেনা..কিন্তু তারপরেও সবাই তৎপর..সবাই সবার ভাই সেখানে..চিনিওনা এমন ছেলে মেয়েরা আসে সাহস দিয়ে যাচ্ছে..সাহায্য করছে..

করিডোর ধরে সামনে আগাতেই একটা চিৎকার শুনলাম..”একটা পুলিশ মরেছে রে”

বিশ্বাস করতে হয়ত কষ্ট হবে..গোটা হাসপাতাল..ভেতরে বাইরের সব মানুষ একসাথে বলে উঠলো আলহামদুলিল্লাহ..

এরকম শিউরে উঠা অনুভূতি কোনদিন পাইনাই..কে মরেছে কিভাবে মরেছে জানিনা..কিন্তু মরেছে শুনেই আলহামদুলিল্লাহ পড়ে উঠলাম..

সেই প্রতিটা মানুষ..যারা এতোটাই অত্যাচারী যে এদের মরার খবর শুনলেই মানুষের মুখ থেকে আলহামদুলিল্লাহ বের হয়ে যায়..এদের জন্যই আল্লাহ এর পক্ষ থেকে জাহান্নাম ওয়াজিব করা হয়েছে আসলে..

নিষ্পাপ সাধারন ছাত্রদের বুকের উপর যারা গুলি চালায়..যারা এটা সমর্থন করে..যারা এটায় সহায়তা করে..যারা এটা হওয়ার সময় মুখ বুজে সম্মতি দেয় সবার জন্য আল্লাহ যেনো এই দুনিয়ায় ই বিচারের ব্যবস্থা রাখেন..কিয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্য যে আমার হবেনাহ..

তানভীনের লাশ নিয়ে সামনে গেটে গেলাম..এম্বুলেন্স আসার অপেক্ষা করছিলাম..আমি একা ছিলাম কিছুক্ষন ওর লাশের পাশে..চোখ গুলা বুজে দিলাম..হাত দুইটা সোজা করলাম..

মাথা থেকে রক্ত পড়া থামেনাই ওর..স্ট্রেচার থেকে রক্ত গড়ায় নিচে পড়ছে টপ টপ করে..আন্টি নিজের ওড়না নিয়ে বললেন তানভীনকে যেনো ঢেকে দেই..

এম্বুলেন্স আসলো..ওকে তোলা হলো..স্ট্রেচার থেকে লাশটা নিয়ে এম্বুলেন্স এর ভেতরে নিলো..

আন্টি তখন পাগলপ্রায়..আন্টি স্ট্রেচার থেকে তানভীনের রক্ত নিয়ে নিজে মেখে চিৎকার করছেন আমার ছেলে শহীদ..আমার ছেলে শহীদ হয়েছে..

এই মুহূর্তটা আমি হয়তো কোনদিন ভুলতে পারবোনাহ..আজীবণ চোখের সামনে আমার এই দৃশ্য আর কানে আন্টির চিৎকার ভাসবে..

আন্টিকে এম্বুলেন্সে উঠতে দিলোনা..এম্বুলেন্সেরো কাঁচ ভাঙা..তানভীনের সাথে ওর আত্বীয়..আমাদের ফ্রেন্ড উঠলো..এমনকি সম্পূর্ণ অপরিচিত ছাত্র ও উঠে গেলো লাশ নিয়ে যেতে সাহায্য করতে..

আন্টিকে বাসায় পাঠায় দেওয়া হলো..আমরা নিজেদের মত করে তানভীনের বাসার দিকে আগাতে লাগলাম..

ওর বাসার নিচে লাশ রাখা হলো..আশপাশ থেকে মানুষজন জড়ো হয়ে দেখতে আসে..

আন্দোলোনে কেউ যায়না..প্রতিবাদে কেউ যায়না..লাশ দেখতে আসা মানুষের ভীড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়..

বাসার নিচেই গোসল করানো হলো তানভীনকে..গোসল করানোর পরেও তার মাথা থেকে রক্ত পড়া থামেনাই..কাফনের কাপড় টুকুও রক্তে ভিজে যাচ্ছিলো..

আমার হাতে তখনো ওর রক্ত লেগে ছিলো..জানাজার আগে ওযু করা অবধি আমি সেই রক্ত ধুতে পারিনাই..

জামতলা মসজিদে বাদ আসর জানাজা পড়ানো হলো..লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি আসলো..তানভীনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাঠায় দেওয়া হলো দাফন করতে..তার পরিবার তার সাথে চলে গেলো..

সবাই বাসায় ফিরে গেলো..সব স্বাভাবিক হয়ে গেলো..

স্বাভাবিক হলোনা খালি তানভীনের কাছের মানুষদের জীবন..স্বাভাবিক হলোনা প্রতিটা শহীদের স্বজনদের জীবন..

নেতা..মন্ত্রি..ছাত্রলীগ..পুলিশ..বিডিআর..বিজিবি..র‍্যাব..সেনাবাহিনী..সবার জীবন স্বাভাবিক..তারা ছাত্রদের উপর দিনে গুলি করে রাত্রে বাড়িতে যায় ঘুমায় যায়..

আপনারা সাধারন মানুষেরা সারাদিন দেশটাকে গালি দিয়ে রাতে ঘুমায় যান..

আমাদের শহীদ ভাইগুলা কবরে শুয়ে জান্নাতের সুঘ্রানে ঘুমায় থাকে..

ঘুমাইতে পারেনা শুধু এই শহীদ দের আপন জনেরা..আসলেই যার হারায় সেই বুঝে..এই কষ্ট আপনারা নিজের না হারানো পর্যন্ত বুঝবেন ও না..আমি আশাও করিনা কারো বুঝার..

যারা নিজের স্বার্থের জন্য এই গনহত্যা করে..তারা না বাঙালী..না মুসলমান..না মানুষ..আল্লাহ কিভাবে এতো ছাড় দেন আমার জানা নাই..কিন্তু আমি আশা করবো এর ফয়সালা যেনো আল্লাহ এই দুনিয়াতেই করে দেন..আমীন

লেখাঃ তৌকির শাহরিয়ার আকাশ
শিক্ষার্থী, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অভ টেকনোলোজি – আইইউটি

Shares: